Kousik Das সূর্য ~ Kousik's Diary

Thursday 25 July 2013

সূর্য

সূর্য অস্ত গেছে প্রায় এক ঘণ্টা । নর্দমার পাশে আবর্জনার স্তূপ গুলোতে দুটো কুকুর কি নিয়ে যেন কামড়া কামড়ি করছে । আঁতকে উঠল সূর্য , কুকুর দুটোর একটা বেশ সাস্থবান , তার থেকেও আকারে বড়, অপর টা রোগা। তার দূরে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া তার আর কোনও উপায় নেই, জতক্ষন পর্যন্ত রোগা কুকুর টা মার খেয়ে পালিয়ে না যাচ্ছে ।
মিউনিসিপালিটির জল টানা গাড়ির ফুটো হওয়া ট্যাঙ্কি টার চাকায় হেলান দিয়ে বসে পড়ল সে । কি যেন ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো তার । চোখের পাতা দুটো লাগলেই আজও তার মনে পড়ে যায় তার বাবার কথা । মিউনিসিপালিটির সুইপার দলের হেড সুইপার ছিল তার বাবা । সেদিন সকালে তার বাবা আর মায়ের মধ্যে কি নিয়ে
যেন কথা কাটাকাটি হয়েছিল তার মনে নেই । সে তখন ছিল মাত্র পাঁচ বছরের । শুধু মায়ের কাছে শুনতে পেরেছিল তার বাবা নাকি সব সুইপার দের অধিকার আদায়ের জন্য কি একটা বিক্ষোভে সামিল হতে গেছে ।তারপর আর বাবা কে কোনও দিন আর দেখা হয়নি তার। হঠাত একটা বিকট শব্দে তার চোখ খুলে গেলো ।

নর্দমার ওপরের ফ্লাই ওভার টা দিয়ে একটা বুলেট ট্রেন ছুটে গেলো গুলির বেগে । সূর্য আবর্জনার স্তূপের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখল , কুকুর দুটো নেই । কিছু না ভেবেই শহরের আবর্জনার মধ্যে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল সে । আজকে এমনিতেই তার অনেক দেরি হয়ে গেছে কুকুর দুটোর জন্য । জলদি তাকে যা খোঁজার খুঁজে নিতে হবে। ভাংরি কাকুর দোকান
আবার বেশি রাত অবধি খোলা থাকে না , শহরের সপিং মল গুলোর মতো । ভাংরি কাকুর দোকানে আবর্জনা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কিছু ধাতু ইত্যাদি বিক্রি করে তাকে খাবার কিনতে হবে মায়ের জন্য । সেদিন সূর্য বাড়ি ফিরে দেখল মা ঘুমিয়ে পরেছে তার । অন্য কোনও দিন অবশ্য এমনটা হয়নি আগে । এইতো দুমাস আগেও তার মা সাহেব
দের বাসায় কাজ করতে যেত । আর সূর্য ঘরে বসে পড়াশুনা করত । মা তার জন্য ভালো কিছু খাবার আনবেই আনবে ঘরে ফেরার সময় । দুমাস হল তার মায়ের কি যেন একটা অসুখ হয়েছে । জ্বর আর কাশি লেগেই থাকে সারাদিন ।

মাকে ডেকে ওঠাল সে ঘুম থকে । দুই টুকরো রুটি হাতে দিয়ে সে বলল - " ডাক্তারের কাছে গেছিলি মা ? কিছু বলল ডাক্তার ? আজকে এতো তারাতারি ঘুমিয়ে পড়লি যে ? " । ..মা জবাব দিল - " হ্যাঁ রে , গেছিলাম । তোকে এতো ভাবতে হবে না । ডাক্তার বলেছে তারাতারি ভালো হয়ে যাবো । আর খুব তারাতারি তোর জন্য আবার চকলেট নিয়ে
আসবো । এই নে একটুকরো , আমার খাওয়া হয়ে গেছে । এটা তুই খেয়ে নে এটা । " । ..রুটির টুকরো টা চিবোতে চিবোতে সূর্য শুয়ে পড়ল মা কে জরিয়ে ধরে । কাশতে কাশতে মা তাকে রাজপুত্র আর পরী দের গল্প শোনাতে লাগলো । তখনকার মতো ঘুমিয়ে পড়ল সূর্য । শেষ রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলো সূর্যের । রোজ এই সময়েই মায়ের কাশি টা বাড়ে ।
কিন্তু আজকে কাশি টা খুব বেশি , কফের সাথে রক্ত ও পরেছে । সূর্য অস্থির হয়ে পড়ল । টেবিল হাতড়ে গোটা দুয়েক ট্যাবলেট দিল মা কে । ট্যাবলেট দুটো খেয়ে শুয়ে পড়ল মা । সূর্য তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । সেই সময় সূর্যের প্রথম কিরন ঝুপড়ীর বস্তার পর্দার ফাঁকা দিয়ে এসে পড়ল আরেক সূর্যের গালে । তাদের বস্তির মানুষ গুলো জলের
জন্য লাইনে লেগেছে । পৌরসভার গাড়িতে ৩০০০ মানুষের জন্য ৩০০০ লিটার জল আসে । সূর্য গিয়ে লাইনে দাঁড়ালো । দুই লিটার জল পাবে সে । একলিটার জল বিক্রি করে দেবে সে পাশের ঝুপড়ীর হাফেজ কাকার কাছে ।বাকি জলটুকু মায়ের জন্য ঘরে রেখে যাবে,আর সে ঐ আবর্জনার স্তূপের কাছে পড়ে থাকা গাড়ি টার তলানিতে থাকা জল
টুকু থেকে নিজের তেষ্টা মিটিয়ে নেবে।

জল নিয়ে ঘড়ে ফিরে সে দেখল মা শুয়ে আছে । সূর্য ডাকল - " কি রে মা , এখনো যে শুয়ে আছিস ? দুটো রুটি করে দে । আমাকে আবার পাথর ভাংতে জেতে হবে । " । ..কোনও সারা পেল না সে । ধক্কা দিয়ে সে যখন ডাকল মায়ের ঠোঁটের পাশে রক্ত দেখে ভয় পেয়ে গেলো সে । দৌরে গিয়ে হাফেজ কাকা কে ডেকে আনলো সে । হাফেজ কাকা
অবস্থা বুঝে সূর্য কে নিয়ে গেলো ডাক্তার ডাকতে । ডাক্তার এসে সূর্য কে বাইরে জেতে বলল । কিছুক্ষন পড়ে নাকে রুমাল চেপে ডাক্তার চলে গেলো । হাফেজ কাকা সূর্য কে বল্ল , " দেখ বাবা , আমি ডাক্তারের ফিজ টা দিয়ে দিয়েছি । কিন্তু অনেক গুলো ওষুধ লিখে দিয়ে গেছেন ডাক্তার বাবু । এগুলোর ব্যাবস্থা তোকেই করতে হবে । অবস্থা বেশি
ভালো না তোর মায়ের । আমি তোর চাচি কে বলছি তোর মায়ের সাথে থাকতে । তুই পারলে ওষুধ গুলোর ব্যাবস্থা কর । " কোনও কথা না বলে কাগজ টা হাতে নিয়ে ছুটে গেলো সূর্য । একজন ১১ -১২ বছরের শিশু যে এতো জোরে ছুটতে পারে , সেটা জানা ছিল না হাফেজের ।

ওষুধের দোকান বলতে সূর্যের একমাত্র ভরসা তাদের বস্তির কাছের ডাক্তার কাকুর দোকানটি । বড় বড় ওষুধের দোকানে ঢুকতে দেয় না তাকে । তবে এইবার যে ওষুধ গুলো ডাক্তার লিখেছে , তা ডাক্তার কাকুর দোকানে পাওয়া যায় না । তবে ডাক্তার কাকু তাকে বলেছে ওষুধ গুলো কিনতে ৬৫০০ টাকা লাগবে । টাকা এনে দিলে ওষুধের যোগার
সে করে দিতে পারবে । তবে এতো গুলো টাকা সূর্য পাবে কোথায় ? সারাদিন পাথর ভেঙ্গে সে তো সবে ৩০০ টাকা পায় । আর আবর্জনার স্তূপ ঘেঁটে খুব বেশি হলে ৫০০ টাকা পবে সে। তার মনে আসলো ভাংরি কাকুর কথা । রোজ তার কাছেই কুরানো জিনিস গুলো বিক্রি করে সে। কিন্তু এতো টাকা পাওয়ার আশা করা টাই যেন কেমন লাগছে তার ।
সূর্য ডুবতে তখনো ঘণ্টা তিন বাকি। আজকে সূর্য পাথর ভাঙ্গার কাজ থেকে তারাতারি চলে এসেছে । তবে তার কাকুতি মিনতির ফলে পুরো দিনের টাকা টাই পেয়েছে সে । চট পট আবার আবর্জনার স্তূপের কাছে চলে গেলো সে । যেমন ভাবা তেমন কাজ, এতো বড় ক্যাশ বাক্স টার থেকে ৪৩০ টাকা বের করে দিয়ে তার আজকের কুড়িয়ে পাওয়া
জিনিষ গুলোর দাম মিটিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে জেতে বলল সে ।

লোহার খাটের কোনে খোলা ক্যাশ বাক্স টা যেন সূর্য কে ডাকছিল । মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে তো সূর্য কে । একবার শুধু সে ভেবে নিল , তারপর কাশবাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একমুঠো কাগজের নোট তুলেই ছুট দিল সে । কিন্তু তার ১২ বছর বয়েসি পা ভাংরি কাকুর দোকানের গেট পার করার আগেই একজন দারোয়ান গোছের লোক তাকে
আটকে ফেললো । পুলিসের হাতে তুলে দেওয়া হল তাকে । বার বার সূর্য বলছিল তার মায়ের কথা । কিন্তু তার চীৎকার কারো কানে জায়নি । ১২ বছরের ছেলে টাকে চুরির দায়ে জেলে ঢোকানো হল । সেদিন সূর্য আবার অস্ত গেলো ।

সূর্য
কৌশিক দাস
১৪-৭-২০১৩

0 comments:

Post a Comment

© 2013 Kousik's Diary , AllRightsReserved.

Designed by Kousik Das